বড় বড় দালান থেকে ইমারত যাই বলা হোক না কেন সকল কিছুই তৈরি হয় ছোট ছোট ইট থেকে।ছোট ছোট ইট একটি আরেকটির ওপর বসিয়ে তৈরি করা হয় উচ্চ দালান,বহুতল ভবন।যে কোনো ধরনের নির্মাণ স্থাপনা তৈরি করতে ইটের প্রয়োজন।আর এই সকল ইট তৈরি করা হয় ইটের ভাটায়।তবে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ ইটের ভাটার কারণে ফসলি জমি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের দেশে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।তবে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে যেখানে সেখানে যত্রতত্র ইটের ভাটা স্থাপন করছে ভাটা মালিকরা।ইটের ভাটাগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে।সেই সাথে ইটের ভাটার দূষণে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইড ও গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে আমাদের জলবায়ুতে প্রভাব ফেলছে।জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে প্রথমত ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।ময়মনসিংহ সিটি সহ জেলার সবগুলো উপজেলাতেই এসব অবৈধ ইটভাটার বিস্তার দিন দিন বাড়ছে!সরজমিনে দেখা গেছে,দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে,ফসলী জমি দখল করে,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,মসজিদ,মন্দির সহ জনবসতি এসব এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ইটভাটা। সরেজমিনে আরও দেখা গেছে,জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার গাবতলির বানারপাড়া এলাকা থেকে শুরু করে,গৌরিপুর,ঈশ্বরগঞ্জ, তারাকান্দা,ফুলপুর,দুবাউড়া,হালুয়াঘাট,ফুলবাড়ীয়া,ত্রিশাল, ভালুকা,গফরগাঁও সহ নান্দাইলে অসংখ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এসব অবৈধ ইটভাটা।সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবের কারণে আইনের তোয়াক্কা না করে চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা।ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ ও সংশোধনী-১৯ বলছে,পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন,হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন,ভার্টিক্যাল শফট ক্লিন,টানেল ক্লিন বা অনুরূপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া আবাসিক,জনবসতি,সংরক্ষিত এলাকার বনভুমি ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।এছাড়া সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবে না।আর এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।আর এসব ইটভাটা তদারকি করার জন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বন বিভাগ,স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারির অভাবে সারাদেশের ইটভাটা মালিক এসব আইনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দেদারসে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।ফলে এর প্রভাব পড়ছে প্রাক প্রকৃতি,জীব বৈচিত্র্য,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,মসজিদ,মন্দির ও জনস্বাস্থ্যের ওপর।সবচেয়ে বড় আঘাত হানছে আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর ওপর।ইটের ভাটায় সাধারণত কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো হয়ে থাকে।এতে কার্বন ডাই অক্সাইড,কার্বন মনোক্সাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরি হয়। যা ইটের ভাটার ধোঁয়ার সাথে বায়ুতে মিশে বায়ুকে দূষিত করে।এই বায়ু দূষণের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট,ফুসফুসে ক্যান্সারসহ নানা রোগ হয়।অবৈধ ইটভাটাগুলোর চিমনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতায় কম।এতে করে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া।বিষাক্ত ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে ইটের ভাটার আশপাশের এলাকা,গাছপালা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসতি।ফল গাছের ফলমূলসহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।এদিকে জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি (টপ সয়েল) ইটভাটাগুলোতে দেওয়ার কারণে জমিগুলো পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে।যার কারণে চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।যে জমি থেকে মাটি যাচ্ছে তার উর্বরতা তো নষ্ট হচ্ছেই,সঙ্গে পাশের উর্বর জমিগুলোও ভেঙে পড়েছে।ওই পাশের জমির মালিক এক সময় বাধ্য হয়েই ইটের ভাটার কাছে মাটি বিক্রি করছে।এতে করে কৃষি আবাদি জমির সংকট দেখা দিচ্ছে।আবার ইটভাটার মাটি,ইট,কয়লা,গাছ বহনের জন্য কৃষিকাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর দিয়ে বানানো মালবাহী ট্রাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে বাহন হিসেবে।এতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে গ্রামীণ সড়কের।যাতায়াতে ভোগান্তিসহ প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।মালবাহী ট্রাক্টর দিয়ে মাটি নেওয়ার সময় অনেক মাটি রাস্তায় পড়ে যায়।হালকা বৃষ্টি হলে এসব মাটি পিচ্ছিল হয়ে রাস্তা কে পিচ্ছিল করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে মানুষের গাড়ি চলাচলে।অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে।এছাড়াও আমাদের দেশে বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ইট ভাটার দূষণ।ইটের ভাটা দূষণ আমাদের পরিবেশকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করছে।অবৈধ ইটের ভাটায় বন উজাড় করে গাছ পোড়ানো হচ্ছে। যার ফলে পরিবেশ থেকে গাছ পালা ও বন জঙ্গলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।গাছপালা বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে।বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইটের ভাটার দূষণ আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।ইতোমধ্যে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছে।গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।বাংলাদেশেরও অনেক জেলা শহর হয়েছে যা সমুদ্রের নিচে চলে যেতে পারে।জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলার কারণে উপকুলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিবে।তাছাড়া জলবায়ুতে প্রভাব ফেলার কারণে ঋতু চক্রের পরিবর্তন ঘটবে।যার ফলে অতি বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি দেখা দিবে।যে সকল অঞ্চলে অতি বৃষ্টি হবে সেসব অঞ্চলে বন্যার কারণে চাষাবাদ সম্ভব হবে না।আবার যে সব অঞ্চলে অনাবৃষ্টি দেখা দিবে সেই অঞ্চলগুলোতে খরা দেখা দিবে।সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হবে না।