ফখর উদ্দিন ইমরান,বিশেষ প্রতিবেদক
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে ৪ শত বছরের বেশি সময়ের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট মঙ্গল বার থেকে শুরু হয়েছে।পৌর এলাকায় প্রেসক্লাব সংলগ্ন পুরাতন বাজারে প্রতিবছর পূজা শুরুর আগের দুদিন এই হাট বসে।চারদিকে ঢাক ঢোল,কাঁসর,সানাই,নানা বাঁশি,করতাল ও খঞ্জরির আওয়াজে প্রকম্পিত এলাকা।কারো হাতে ঢোল বাঁশি সহ নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র।বাজারের রাস্তায় বাজনা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে পূজারীদের মন আকৃষ্ট করছে ঢাকিরা।এমন দৃশ্য মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে বুধবার পর্যন্ত।যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে আছে এই ঢাকের হাটের ঐতিহ্য।দূরদূরান্ত থেকে পূজারীরা এই হাটে আসেন পছন্দের বাদক দলটি বাছাই করে নিয়ে যেতে। তাদের আকৃষ্ট করতে নানান রকম ছন্দে ঢাক ঢোল,বাঁশি বাজিয়ে তাদের মুনশিয়ানা দেখায়।বাজনা পছন্দ হলেই শুরু হয় বায়না করার আলাপ আলোচনা।কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয় উপস্থিত পরীক্ষার মাধ্যমে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টা করেন ঢাকিরা।বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।যাদের সঙ্গে দরদাম মিলছে,তাদের অনুসরণ করে পিছু নেন ঢাকিরা।কটিয়াদীর এই ঢাকের হাটের ইতিহাস ৪০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো।এ কারণে হাটটি জেলার সব ধর্মের মানুষের কাছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে।হাট বসে দুর্গাপূজা ঘিরে।পঞ্চমী ও ষষ্ঠী হাটবার এবারও একই নিয়ম মেনে পুরানবাজারে বসেছে ঢাকের হাট।মঙ্গলবারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজনা বাজাচ্ছেন তারা।কেউ রিকশা থেকে দলবল নিয়ে সবেমাত্র নামছেন।কেউ আগের রাতেই এসেছেন।কেউ চুক্তি হয়ে চলে যাচ্ছেন,অনেক দল বায়না না হওয়া পর্যন্ত হাটে অবস্থান করবেন।স্থানীয় সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পূজারিরা এসেছেন পছন্দের বাদক দলটি নিতে। ৩০-৪০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকায় চুক্তি হয়ে অনেক দল চলে গেছে।জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন।কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান।সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন।রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন।সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু।পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে।এখনো হাট বসে সেখানে।
ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ থেকে আগত বরুণ দাস বলেন, আমার দলে ছয় সদস্যের ঢাকি।একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে একসাথে আমরা চল্লিশ জন আসছি।বায়না হলে বিভিন্ন পূজা মন্ডবে চলে যাবো।নরসিংদীর বেলাবো থেকে আসা নিমায় বলেন,এইবার স্থানীয়ভাবে চুক্তি হয়নি,তাই কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসলাম।পাঁচ সদস্যের দল আমাদের,ত্রিশ হাজার চাচ্ছি।বিশ হাজার বায়না বলা হচ্ছে।আরেকটু দেখে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাবো।কটিয়াদী উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব প্রভাষক ধ্রুব রঞ্জন দাস বলেন,এই ঢাকের হাট আমাদের ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ঢাকিদের দেখাশোনা ও তদারকি করছি।হাটে অস্থায়ী মনিটরিং কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।এলাকাবাসী সবাই সহযোগিতা করছে।কটিয়াদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন,ঢাকিদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কাজ করছে।শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে হাট চলছে।