অভিনন্দন !
৮ম ‘দৈনিক বাঙ্গালীর কণ্ঠ পুরস্কার ২০২৩’ এর ‘কণ্ঠশিল্পী’ বিভাগে পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী তিমির নন্দী।
❑
তিমির নন্দী-র সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত :
মুক্তিযোদ্ধা এই শিল্পীর বয়স যখন মাত্র সাড়ে তিন বছর, কোন ওস্তাদ ছাড়াই তাঁর তবলা বাজানো সেই থেকে শুরু। বাড়ীতে মা প্রয়াত রানু নন্দী গান গাইতেন এবং এস্রাজ বাজাতেন। বড় বোনেরা গান গাইতো এবং নাচতো। ফলে সাং®কৃতিক পরিমন্ডলেই তিমিরের বেড়ে ওঠা। বাবা প্রয়াত দেবেন্দ্র নাথ নন্দী সরকারী চাকুরী করতেন বিধায় তিমিরকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়।
পাঁচ বছর বয়সে নিজেই হারমনিয়ামে সুর তুলে এবং বোনদের গানের সুরে ভুল ধরিয়ে দিয়ে আবাক করেন বাসার সবাইকে। বিভিন্ন অনূষ্ঠানে ডাক পড়ে তিমিরের। কখনো বা গান গেয়ে আবার কখনো বা বোনদের গানে তবলা সঙ্গত করে দর্শক মাতাতে থাকেন এই ক্ষুদে শিল্পী। তৃতীয় শ্রেনীতে অধ্যায়নকালে তিমির বেঞ্জো বাজানো শেখেন। ষাটের দশকেই তিনি অনেক সোনার মেডেল গলায় ঝুলান। এরপর থেকে অনেক মেডেল, ট্রফি, কাপ তিনি নিজের করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং সঙ্গীত প্রতিযোগীতার মাধ্যমে।
তিমির যখন বাগেরহাটে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র, তখন তিনি ওস্তাদ দুলাল কৃষ্ণ দেবনাথের অনুরোধে তবলা ছেড়ে তাঁর কাছেই প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেয়া শুরু করেন। সেই বছর স্থানীয় সিনেমা হলে একটি সাং®কৃতিক অনুষ্ঠানে খেয়াল-রাগ ইমন ও নজরুল সঙ্গীত “কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা” পরিবেশন করার পর উক্ত অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আগত বিশিষ্ট সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ মঞ্চে ছুটে এসে দর্শক সম্মুখে তিমিরকে এক ঝট্কায় কোলে তুলে চুমু খান। ঐ অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার ও গণসঙ্গীত শিল্পী শেখ লুৎফর রহমান ও বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শবনম মুস্তারী। শহীদ আলতাফ মাহমুদ তিমিরের গানে মুগ্ধ হয়ে বলেন-“তুমি ঢাকায় চলে আসো।”
এরপর তিমির যান রাজশাহী। সেখানে তিনি ওস্তাদ হরিপদ দাস-এর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে থাকেন। ওস্তাদজীর আরো অনেক ছাত্রের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট সুরকার ও কন্ঠশিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা অনুপ ভট্টাচার্য।
১৯৬৮ সালের শেষ দিকে তিমির ঢাকা আসেন এবং পরের বছর তাঁর প্রয়াত মেজভাই তরুণ কুমার নন্দী-র ইচ্ছায় বিভাগীয় সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় নাম লেখান এবং ঢাকা বিভাগে পল-ীগীতিতে ১ম ও আধুনিক গানে ২য় হন। পরবর্তিতে শুরু হয় ইস্ট পাকিস্তান মিউজিক কম্পিটিশন যেখানে তিমির আধুনিক গানে ১ম ও পল¬ীগীতিতে ২য় হয়ে আলোচনায় চলে আসেন। তখনকার বিচারক মন্ডলীর মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট সুরকার সমর দাস, খন্দকার নূরুল আলম, বিশিষ্ট মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ প্রমুখ।
পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশ, চিত্রালীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ১ম পাতায় তিমিরের ছবিসহ খবর প্রকাশ পায়। ঢাকার লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি বয়েজ হাই স্কুলের এই ছাত্রের কৃতিত্বে গর্বিত হয়ে তাঁর স্কুল এক দিনের ছুটির ঘোষণা দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করে। রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন থেকে প্রযোজকরা আসেন তিমিরের ঢাকার কলাবাগানের বাসায়। নিয়ে যান তাঁরা রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনে। সেই ১৯৬৯ সাল থেকেই এই শিল্পী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিতভাবে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন এবং ওস্তাদ আমিনুল ইসলামের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে থাকেন। তাঁর সাথে আরো যারা শিখতেন, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদেরী কিবরিয়া এবং ডঃ অরূপ রতন চৌধুরী ছিলেন। সে সময় দেশের প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন তার গানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিমির বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও শিল্পী ওস্তাদ সুধীন দাসের কাছেও নজরুল সঙ্গীতে তালিম নিতে থাকেন।
১৯৭১ সালে কিশোর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিমির কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট অঞ্চলে গণসঙ্গীত ও দেশের গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। কুড়িগ্রাম জেলার বাগুয়া গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ বাহিনীকে রুখতে তিনি লাঠি হাতে সারারাত গ্রাম পাহারা দিতেন। তিমিরের অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও মায়ের কথায় নত হয়ে তিনি কলকাতার বালীগঞ্জে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন। এ ছাড়াও তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব এম.এ.মান্নান এম.পি. সাহেবের গঠিত “শরনার্থী শিল্পী গোষ্ঠী”তে যোগ দিয়ে শরনার্থী শিবিরসহ, বিভিন্ন ওয়ার ক্যাম্প, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়ে গণজাগরণ তৈরী করেছেন, বিভিন্ন সীমান্তে যেয়ে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রানিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন, অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত সম্মানী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে দান করেছেন, যা তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন।
এখানে বলাইবাহুল্য যে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিমিরদের লালমাটিয়াস্থ বাসায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা বোমা মেরে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু লুট করে নিয়ে যায়। ফলে সঙ্গীতে তার ছোটবেলায় পাওয়া যত সোনার মেডেল-ট্রফি-কাপ সবই লুট হয়ে যায়। ছোটবেলার কোন স্মৃতিই আর অবশিষ্ট থাকেনা।
১৯৭২ সালে তিমির ওস্তাদ মুন্শী রইস উদ্দিনের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে থাকেন। পাশাপাশি বিশিষ্ট নজরুল এবং গণসঙ্গীত শিল্পী, সুরকার শেখ লুৎফর রহমান ও সুখেন চক্রবর্ত্তীর কাছে নজরুল সঙ্গীত ও গণসঙ্গীতে তালিম নেন।
১৯৭৩ সালে মিউজিক কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের বৃত্তি পেয়ে তিমির সঙ্গীতে উচ্চ শিক্ষার্থে রাশিয়া চলে যান। সেখানে তিনি ৮মাসে রাশিয়ান ভাষা মোটামুটি রপ্ত করে শুরু করেন অনুষ্ঠান। তাঁর গাওয়া রাশিয়ান গান শুনে অবাক হয়ে যায় সেখানকার দর্শক। ফুলে ফুলে ভরে যায় তার গ্র্যান্ড পিয়ানোর ডালা। তিমির অনেকগুলো যন্ত্র বাজাতে শেখেন, বেঞ্জু, গীটার, পিয়ানো, সিলভার ফ্লুট, সাক্সোফোন, এ্যকোর্ডিয়ন, ড্রামস্, রাশিয়ার দোমরা, বালালাইকা প্রভৃতি। এরপর তিনি সেখানকার স্থানীয় টিভি চ্যানেলে মাঝে মাঝে গাইতে থাকেন। বিভিন্ন সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় সব সময়ই ১ম হন। তিমির সেখানে এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, এরপর থেকে তিমিরকে প্রতিযোগীতার বদলে ৩০মিনিটের জন্য মঞ্চ ছেড়ে দেয়া হয়, কারণ দর্শক তিমিরের গান শুনতে চান। কখনো পিয়ানো, কখনো হারমনিয়াম, আবার কখনো বা গীটার বাজিয়ে তিমির পরিবেশন করেন রাশিয়ান, বাংলা, স্প্যানিশ ও ইংরেজী গান। র¯ōভ-অন-ডন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গীত শিক্ষক মিঃ ব্রাগেন একমাত্র তিমিরকে ব্যান্ডে একক কন্ঠশিল্পী হিসেবে বিবেচিত করেন । এমন কি কোন রাশিয়ান ছাত্র-ছাত্রীও এই সুযোগ পাননি। ২৫ হাজার দর্শক ভরা ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একমাত্র তিমিরই সুযোগ পান বিভিন্ন দেশ হতে আগত খ্যতিমান শিল্পীদের সঙ্গে একক গান গাওয়ার। বিখ্যাত ছায়াছবি “গড ফাদার”-এর “স্পিক সফট্লি ল্যভ” গানটি গেয়ে বিশেষ পুরষ্কার অর্জন করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন ।
একবার বেলোরুশিয়ায় এক বৃদ্ধা দর্শক তিমিরের গান শুনে ফুল হাতে মঞ্চে এসে আদর করেন। চোখ দিয়ে অনবরত তাঁর অশ্র“ ঝরছে। বলেন- “দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছি। তোমার রাশিয়ান গানটি আমার একাকীত্বকে আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে। এত সুন্দর, এত দরদ দিয়ে গেয়েছো যে, চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তুমি অনেক বড় শিল্পী হবে।” তিমির আরো একবার মঞ্চে কয়েকজন তরুণীকে বাংলা গান শুনিয়ে কাঁদান। যেটির সারমর্ম গাইবার আগেই বলা হয়েছিল। তাঁর কন্ঠে এতই আবেগ ছিল যে, তরুণীরা কান্না থামাতে পারেননি। এসব এখনও তাঁর স্মৃতিতে উজ্বল হয়ে রয়েছে। এগুলি তাঁর জীবনের পরম পাওয়া বলে তিনি মনে করেন।
রাশিয়ায় সঙ্গীতে মাস্টার্স করার পর সেন্ট পিটার্সবুর্গের অবস্থিত তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিমিরকে পি.এইচ.ডি করার প্রস্তাব দেন এবং দেশে ফিরে সরকারী অনুমতি নিতে বলেন। তিমির দেশে ফিরে তৎকালীন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করলে মন্ত্রণালয় তাঁকে পি.এইচ.ডি করার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। পরে এই শিল্পী পি.এইচ.ডি করার অনুমতি না পেয়ে দেশেই থেকে যান এবং নতুন করে রেডিও এবং টিভিতে গাইতে শুরু করেন।
তিনি আধুনিক গান ছাড়াও দেশের গান গেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো যেমন, মহান স্বাধীনতা দিবস, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র উপস্থিতিতে মহান স্বাধীনতা দিবসে শিশু-কিশোর সমাবেশে থিম্ সং পরিবেশন করা, মহান বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিমির অপরিহার্য্য। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন মঞ্চ থেকে গণজাগরণমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেছেন। তিনি শুধু কন্ঠশিল্পীই নন, তিনি বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনের একজন বিশেষ শ্রেনীর সঙ্গীত পরিচালকও। গানে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি তিনি বেশকিছু টিভি নাটকে সফলতার সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।
তিমির সঙ্গীতের পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন ঢাকার স্বনামধন্য দু’টি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে। তার একক, দ্বৈত ও যৌথ গানের ক্যাসেট ও সিডি বাজারে ছিল। ২০০৯ সালে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সঙ্গীত পরিবেশনের ৪০ বছর উপলক্ষে সঙ্গীতা’র ব্যানারে “বাধন খুলে দিলাম” এবং ২০১৯ সালে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সঙ্গীত পরিবেশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে “মেঘলা দু’চোখ” শিরোনামে জি-সিরিজের ব্যানারে সর্বশেষ এ্যালবাম বের হয়। গান গাওয়ার পাশাপাশি তিমির নন্দী পিয়ানো শেখান। তাঁর অনেক ছাত্র-ছাত্রী ট্রিনিটি কলেজ লন্ডন-এ স্টাফ নোটেশনে (আন্তর্জাতিক স¦রলিপি) নিয়মিত থিওরী এবং প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে সফলতার সঙ্গে পাশ করছে।
তিমির ২০১২ সালে ইতালীর রোমে শহীদ মিনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য তিনটি ভাষার গানের স্টাফ নোটেশন (১. মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা, ২. ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায় এবং ৩. ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেল প্রাণ) এবং একই বছর লন্ডন অলিম্পিকের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের স্টাফ নোটেশন করে দেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক কাজের ব্যাপারে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে উর্ধতন কর্মকর্তারা তিমিরের সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে স্টাফ নোটেশন করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বর্তমানে উপরোলি−খিত তিনটি ভাষার গানের স্টাফ নোটেশন বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
মেহবুবা হক রুমা
প্রধান সমন্বয়কারী, অনুষ্ঠান আয়োজন কমিটি